মুহাম্মদ দিদার হোসাইন, বাঁশখালী,চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা-বাঁশখালীর সীমানায় সাঙ্গু নদীর উপর নির্মিত তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপারে সরকার নির্ধারিত নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই চালকদের জিম্মি করে আদায় করছে অতিরিক্ত টোল। অনিয়ম ঢাকাতে ইজারাদার কতৃপক্ষ দিচ্ছেনা টোল রসিদ। এমন অভিযোগ করেন চালকরা।চট্টগ্রামের আনোয়ারা-বাঁশখালী সংযোগ সেতু অর্থাৎ ৫২১ মিটার দীর্ঘ সাঙ্গু নদীর উপর ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। নির্মাণ কাজ শেষে গত ২০০৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ইজারাদার কতৃপক্ষ টোল আদায় করে থাকেন ইজারাদার দায়িত্ব পাওয়া লোকজন।গত টেন্ডারকালে সর্বোচ্চ করদাতা মনোনীত হওয়ায় জহির উদ্দীনের মালিকানাধীন জে.এ ট্রেডিং নামক এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে ইজারার দায়িত্ব পান চন্দনাইশের এলডিপির সভাপতি আইনুল কবির।৫২১ মিটার দীর্ঘ সাঙ্গু নদীর উপর নির্মিত তৈলারদ্বীপ সেতুটি সর্বশেষ প্রায় ৩২ কোটি টাকা ইজারা ধার্য্যে অর্থবছরের (২০২৩ -২০২৬) ৩ বছরের জন্যে ইজারার নিয়েছেন কথিত এলডিপি নেতা আইনুল কবির। জে.এ ট্রেডিং নামক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স মালিক জহির উদ্দীন ইজারাদার আইনুল কবির মামা বলে জানা গেছে। টোল আদায়ের শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে এই ইজারাদারের বিরুদ্ধে।ইজারাদার আইনুল কবিরের কাছে সব অনিয়মই যেনো নিয়ম।
জানা যায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালী-আনোয়ারা সংযোগস্থল তৈলারদ্বীপ সেতু পারাপারে ১৩ ধরনের গাড়ি থেকে টোল আদায়ের সরকারি হার নির্ধারণ করা রয়েছে। তবে ইজারাদার সরকারি নির্ধারিত হারের তোয়াক্কা করছেনা। মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মিনি পিকআপ, মিডিয়াম ট্রাক ও হেভিওয়েট ট্রাকশ্রেণির যানবাহন থেকে নির্ধারিত টোলের চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বাড়তি টোল আদায় করছে ইজারাদার।
এমনকি সড়ক ও জনপথ দক্ষিণ বিভাগের সঙ্গে ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের চুক্তির শর্তাবলিতে নির্ধারিত হারে টোল আদায়ের রসিদ ছাপানোর কথা বলা হলেও বাড়তি টাকা লিখে রসিদ ছাপানো হয়েছে। ট্রেইলার-জাতীয় যানবাহন প্রতিবার সেতু পারাপারে ৩০০ টাকা নির্ধারণ থাকলেও ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে হেভিওয়েট ট্রাক পারাপারে ১৮০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। মাঝারি ট্রাকে ১৫০ টাকার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা।মাইক্রোবাসে ৬০ টাকার স্থলে ৮০ টাকা, প্রাইভেট কার ৪০ টাকার স্থলে ৫০ -৬০ টাকা আদায় করা হচ্ছে, এছাড়াও সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে ১০ টাকার স্কুলে ১৫ টাকা, মোটরসাইকেল ৫ টাকার স্কুলে ১০ টাকা। এভাবে অতিরিক্ত টোল আদায় করা হলেও দেয়া হয়না কোন ধরনের টোল রসিদ (টোকেন)। যাহা ২৬ জুন ২০১৪ এর সংশোধিত নীতিমালার পরিপন্থীও বটে। বাড়তি টাকার পরিমাণ উল্লেখে টোল রসিদ ছাপিয়ে ওই রসিদ মুলে টোল আদায় সংক্রান্তে ইতিপূর্বে বেশ কয়েক বার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পর বাড়তি টোল আদায় করা হলেও দিচ্ছেনা টোল রসিদ। ট্রাক চালক আবু তৈয়ব, মুজিবুর রহমান, মোঃ কাদের, আকতার হোসেন, সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক খালেক, তৌহিদ, নাছির উদ্দীন, আলী হোসেন, বেলাল উদ্দিন, পিকাপ চালক আনিসুল হকসহ বেশ কয়েকজন চালকের সাথে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
এছাড়াও ওই নীতিমালা পর্যালোচনায় দেখা যায়, টোল আদায়কালে ইজারাদার কতৃপক্ষ টোল আদায়কালে টোল দাতাদের টোল রসিদ প্রদানের কথা বলা হয়েছে, টোল আদায়ের উদ্দেশ্যে স্পীড ব্রেকার স্থাপন করে সড়কে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা, সরকার নির্ধারিত টোলের পরিমাণের মূল্য তালিকা রং দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে লিখে সাইনবোর্ড তৈরি করে টাঙ্গিয়ে দেওয়া, টোল কর্মীদের ইউনিফর্ম থাকা, টোল আদায়স্থলে শৌচাগার স্থাপন করাসহ বিভিন্ন শর্তাবলি নীতিমালায় বলা হলেও ওইসব শর্তাবলির কোন তোয়াক্কা করছেনা ইজারাদার কতৃপক্ষ। যে মূল্য তালিকা টাঙানো রয়েছে তা পূর্বের ইজারাদার কতৃপক্ষের টাঙানো টোলের মূল্য তালিকা বলেও জানা গেছে। স্পীড ব্রেকার দিয়ে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করার ফলে অতিষ্ঠ যাত্রীরা।তাছাড়া নীতিমালায় ইজারার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করদাতা নির্বাচিত হওয়া ইজারাদার কতৃপক্ষকে প্রকৌশলীর সাথে ৩শ টাকা মূল্যের নন জুড়িশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিনামা সম্পাদন করা, টোল আদায় সরঞ্জামাদি স্থাপন করার কথা উল্লেখ থাকলেও কোন ধরনের সরঞ্জামাদি ব্যতীত ইজারাদার নিযুক্ত টোল কর্মীদের মাধ্যমে অতিরিক্ত টোল আদায় করে যাচ্ছে কতৃপক্ষ। ওই নীতিমালায় উল্লেখিত শর্তাবলি পরিপন্থী কিংবা শর্ত ভঙ্গ করিলে ইজারা বাতিল হবে মর্মেও উল্লেখ রয়েছে। তৈলারদ্বীপ ব্রীজে টোল আদায়ে নানা অনিয়ম ও শর্তপরিপন্থী কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও দেখার নেই।
এবিষয়ে টোল প্লাজায় দায়িত্বরত আজিজ হকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রায় ৩২ কোটি টাকা ইজারা ধার্য্যে ৩ বছরের জন্যে ইজারা নেওয়া হয়েছে, আগামী কোরবান আসলে মাত্র ১ বছর পূর্ণ হবে। বড় ট্রাক, কন্টিন টিলার, ভারী মালবাহী গাড়ী থেকে ৩০০ টাকা, বাঁশখালী -আনোয়ারার বাস থেকে ১৫ টাকা, মিনি ট্রাক থেকে ৭০ টাকা, বড় ট্রাক থেকে ১৫০ টাকা, সিএনজি থেকে ১৫ টাকা, মোটরসাইকেল থেকে ১০ টাকা করে আদায় করছে বলে জানান তিনি।
এসময় টোল আদায়ের ক্ষেত্রে টোল দাতাদের টোলের রশিদ প্রদান করা হয় কিনা? ইজারাদার নীতিমালা অনুসারে কতৃপক্ষ প্রকৌশলীর সাথে ৩শ টাকা মূল্যের নন-জুড়িশিয়াল ষ্ট্যাম্পের মাধ্যমে চক্তিনামা সম্পাদন করা হয়েছে কিনা? টোল আদায়ের উদ্দেশ্য সড়কে স্পীড ব্রেকার স্থাপন করা নীতিমালার পরিপন্থী কিনা? শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছে কিনা? সরকার নির্ধারিত মুল্য তালিকা সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, টোল আদায়ের ক্ষেত্রে কেউ রশিদ চাইলে রশিদ দেওয়া হয়, আর না চাইলে রশিদ প্রদান করা হয়না বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, মূল্য তালিকা টাঙানো আছে, তবে লেখা একটু ছোট আকারের হওয়াতে আরো বড় করে লিখে নতুন ভাবে মূল্য তালিকা টাঙানো হবে।
তিনি আরও বলেন, ভাই আমরা মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে থাকি। আর স্পীড ব্রেকার আমরা দিই নাই। টোল এলাকায় প্রায় সময় গাড়ী এক্সিডেন্টের ঘটনা ঘটে, তাই দূর্ঘটনা এড়াতে হাটহাজারী থেকে সড়ক বিভাগের লোকজন এসে স্পীড ব্রেকার স্থাপন করে দিয়েছে, আর নীতিমালা বা ইজারার শর্ত সংক্রান্তে আমরা কিছু বলতে পারবোনা, কারণ এইসব বিষয়ে আমাদের জানা নেই, মালিকের সাথে যোগাযোগ করলে এবিষয়ে জানতে পারবেন।
নীতিমালার শর্ত মোতাবেক চুক্তিনামা সম্পাদন সংক্রান্তে জানতে বাঁশখালী উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদ এর যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এরই মধ্যে ইজারাদার কতৃপক্ষের অনিয়ম ও হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়ে তৈলারদ্বীপ ব্রীজটির টোল প্রত্যাহারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন,রাজনৈতিক সংগঠনসহ স্থানীয় সচেতন মহল। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিভিন্ন প্রার্থীদের কাছে ভোটাররা তৈলারদ্বীপ সেতুর টোল বন্ধের দাবি রাখার ফলে এমপি নির্বাচিত হলে ওই সেতুর টোল বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেন মুজিবুর রহমান সিআইপি।নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এরই মধ্যে টোল বন্ধ করার বিষয়ে তৎপর রয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে (এলডিপির চন্দনাইশ সভাপতি) আইনুল কবির (ইজারাদার) বাঁশখালীর বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান সিআইপিকে বিরূপ মন্তব্য করার একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরালকৃত অভিও ক্লিপে শোনা যায়, আইনুল কবির একপর্যায়ে বাঁশখালীর বর্তমান এমপিকে বাঁশখাইল্ল্যা বলদ বলে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে। এতে তিনি বলতে শোনা যায় যে বাঁশখাইল্ল্যা বলদের খেলতে ইচ্ছা থাকলে আমার সাথে খেলতে আসতে বলো। কথিত এলডিপি নেতা আইনুল কবিরের এমন মন্তব্য সাধারণ মহলের দৃষ্টিগোচর হওয়াতে জনসাধারণের রোষানলে পড়েছে মুজিবুর রহমান সিআইপি (এমপি)। এই নিয়ে বাঁশখালীজুড়ে উত্তেজনা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
Leave a Reply