দৈনিক সবুজ বাংলা ডেস্কঃ
বাঁশখালী যেনো এখন এক রোহিঙ্গা ঘাটি, উপজেলার গণ্ডামারা, সরল, ছনুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুল নেপথ্যে রয়েছে ইউপি সদস্য, চৌকিদার, ইউপি সচিবসহ প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের যোগসাজশের তথ্য।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে দিতে দেয়া হয়েছে জন্ম নিবন্ধন, চেয়ারম্যান সনদ, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টস। উপজেলার গণ্ডামারা,সরল ও ছনুয়া এলাকায় ভোটার হওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকরা জাতীয় পরিচয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ডসহ নিয়ে রোহিঙ্গা নাগরিকরা পাসপোর্ট করতে গিয়ে পুলিশ ভেরিফাইকালে উঠে আসে রোহিঙ্গা নাগরিক বাঁশখালীতে ভোটার করার গোপন তথ্য। রোহিঙ্গা আতংকে পুরো বাঁশখালীজুড়ে চলছে তোলপাড়।
টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউপির ২নং ওয়ার্ড এলাকার মৃত জিন্নাত আলী ও নবিচ খাতুনের সন্তান সাজিয়ে রোহিঙ্গা নাগরিক কেফায়েতুল্লাহর নামে জন্মনিবন্ধন, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, ওয়ারিশ সনদসহ জাতীয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড) বানিয়ে দিয়েছে চৌকিদার আবু বক্কর ও ইউপি শাহ আলম, একই ভাবে উপজেলার ৭ নং সরল ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড মোহাল্যার বাড়ী এলাকার মফিজুর রহমান ও নাছিমা বেগমের সন্তান সাজিয়ে মোহাম্মদ জুহার নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিকের নামে করা হয়েছে জাতীয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড), এছাড়াও একই উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ছালেহ আহমদ সিকদার বাড়ি আব্দুল মতলব ও কামরুন নেছার মেয়ে সাজিয়ে হামিদা বেগম নামে আরো এক রোহিঙ্গা নারীর নামে জন্ম নিবন্ধন করা হয়েছে।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৯ অক্টোবর (বুধবার) সরেজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয়রা বলেন, গণ্ডামারা ইউপির ২ নং ওয়ার্ডের মৃত আমির হোসেন এর মেয়ে বেবি আক্তারকে বিয়ে করে ঘরজামাই থাকার সুবাদে টাকার বিনিময়ে কেফাতুল্লাহ নামে ওই রোহিঙ্গা নাগরিককে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়পত্র করে দিয়েছে ২ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার আবু বক্কর এবং ইউপি সদস্য শাহ আলম ওরফে মদন মেম্বারসহ সংশ্লিষ্টরা। রোহিঙ্গা নাগরিক কেফাতুল্লাহ ওইসব ডকুমেন্টস নিয়ে পাসপোর্ট করার আবেদন করাতে পাসপোর্ট ভেরিফাই প্রতিবেদনের দায়িত্ব পান সাব ইন্সপেক্টর (ডিএসবি) বাঁশখালী মোঃ ফারুক। তদন্তকালে ডকুমেন্টসে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ওইসব লোক রোহিঙ্গা নাগরিক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পাসপোর্ট কার্যক্রম স্থগিত করতে রিপোর্ট প্রদান পাসপোর্ট আটকে দিয়েছে জানিয়েছে সাব ইন্সপেক্টর (ডিএসবি) মোঃ ফারুক।
রোহিঙ্গা নাগরিক কেফাতুল্লাহর স্ত্রী বেবি আক্তার বলেন, আমার স্বামীর বাড়ি কক্সবাজার, তার মা-বাবা কেউ নেই, স্বামী কেফাতুল্লাকে ভোটার করতে চৌকিদার আবু বক্কর ২৫ হাজার টাকা, অন্য একজনে নিয়েছে ২৫ হাজার, সর্বমোট ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিক কেফাতুল্লাহর স্ত্রী বেবি আক্তার। টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাকে ভোটার করার বিষয়ে জানতে চাইলে চৌকিদার আবু বক্কর বলেন, এই বিষয়ে কোন কিছুই জানিনা, তাদেরকে চিনিওনা বলে বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করেন আবু বক্কর। ইউপি সদস্য শাহ আলম বলেন, আমি অশিক্ষিত মানুষ, কোন সময় কার ফাইলে স্বাক্ষর দিয়েছি, আর স্বাক্ষর কে নিয়েছে সেটাতো আমার জানা নেই।
বিষয়টি জানাজানি হলে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি অভিযোগ করেন মৃত জিন্নাত আলীর পুত্র জাকের হোসেন ও নবী হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। অভিযোগকারী জাকের ও নবী হোসেন বলেন, আমরা ২ ভাই ১ বোন, কিন্তু পাশ্ববর্তী এলাকার আমির হোসেনের মেয়ে বেবি আক্তারকে বিয়ে করে ঘরজামাই থাকা কেফাতুল্লাহ ওরফে বার্মাইয়াকে আমাদের বাবা -মার সন্তান সাজিয়ে এই রোহিঙ্গা নাগরিককে ভোটার করে দিয়েছে,বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনও বরাবর অভিযোগ দিয়েছি, এই অনৈতিক কাজের জড়িত চৌকিদার ও ইউপি সদস্যের শাস্তির দাবি করেছে মৃত জিন্নাত আলীর পরিবারের সদস্যরা।
সরল ইউনিয়নের বেশকিছু লোক বলেন, ইউপি সদস্য রশিদ আহমদ (ওরফে চুল রশিদ) বড় অংকের টাকার বিনিময়ে এই এলাকার মফিজুর রহমান ও নাছিমা বেগমের সন্তান সাজিয়ে মোহাম্মদ জুহার নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিককে ভোটার করে দিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। মুলত মফিজুর রহমান ও নাছিমা বেগমের ছেলে আলী আকবর (প্রবাসী) কক্সবাজার এলাকায় থাকতো, তার সাথে ওই রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ জুহারের পরিচয়ের সুবাদে এখানে ভোটার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে ধারণা করছে স্থানীয়রা। আর টাকার বিনিময়ে ৮ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রশিদ আহমদ এবং চৌকিদার মোঃ মোর্শেদ এই কাজ করে দিয়েছে বলেও জানান স্থানীয়রা।
৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছে ইউপি সদস্য রশিদ আহমেদ, তার সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করলেও মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি।
তবে চৌকিদার মোঃ মোর্শেদ বলেন, মফিজুর রহমানের পরিবার আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়, তার ছেলে আলী আকবর (প্রবাসী) এক সময় কক্সবাজারে থাকতো, সে সুবাদে হয়তো রোহিঙ্গার সাথে আলী আকবরের পরিচয় হতে পারে। তবে রোহিঙ্গা মোহাম্মদ জুহারের ভোটার হওয়ার পর মফিজুর রহমানের স্ত্রী নাছিমা বেগম ওই রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ জুহারের ভোটার বাতিল করতে আবেদন করেছে, সেই আবেদনের কপি তার আছে বলে জানিয়েছে চৌকিদার মোর্শেদ।
একইভাবে উপজেলার ছনুয়া ইউপি সচিব আনছার উল্লাহ, ১ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার এবং ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হামিদা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারীকে জন্ম নিবন্ধন করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আত্মগোপন রয়েছে ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ, তার সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করলেও মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি। একই ভাবে ১ নং ইউপি সদস্য রেজাউল করিমও আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। ছনুয়া ইউপি সচিব আনছার উল্লাহর সাথে যোগাযোগের একাধিক বার চেষ্টা করলেও মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের কোন ধরনের তোয়াক্কা না করেই টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধন, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টস দিয়েছে গণ্ডামারা ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বার শাহ আলম, চৌকিদার আবু বক্কর , সরলের ৮ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য রশিদ আহমেদ, চৌকিদার মোর্শেদ, ছনুয়া ইউপি সচিব আনছার উল্লাহ, ১ নং ওয়ার্ডের চৌকিদার এবং চেয়ারম্যান হারুন রশীদ। এই নিয়ে বাঁশখালীজুড়ে তোলপাড় চলছে।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হারুন মোল্লা বলেন,
গণ্ডামারা ২ নং ওয়ার্ডে রোহিঙ্গা নাগরিক কেফাতুল্লাহ, সরলের ৮ নং ওয়ার্ডে রোহিঙ্গা নাগরিক মোহাম্মদ জুহারকে ভোটার করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ পেয়েছি, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে মামলা করা হবে বলে জানান তিনি, এসময় তিনি আরো বলেন, গণ্ডামারা এলাকায় কেফাতুল্লাহ নামে যে রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে তার ফাইলটা সম্ভবত ওই এলাকার চৌকিদার এখানে আনছিল। তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন হারুন মোল্লা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, এবিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply