মুহাম্মদ দিদার হোসাইন:
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস,যাহা সচারাচর মে দিবস হিসেবে অবহিত।প্রতিবছর পহেলা মে দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়।মূলত এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন উদযাপন দিবস।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিক সংগঠন গুলো রাজপথে সংগঠিত ভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করে থাকেন।আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশে ১ মে তথা এই দিবসে জাতীয় ছুটির দিন।এছাড়াও আরো অনেক দেশে বেসরকারিভাবে এই দিবস পালিত হয়।
আমাদের দেশে এক শ্রেণীর মানুষ শ্রমজীবী মানুষ গুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনে করে শুধু তা নয় বরং শ্রমজীবী মানুষ গুলোকে শুধু বিত্তশালীরা কর্মচারী হিসেবেই চোখে দেখে,অথচ শ্রমজীবীরাই যে সোনার সন্তান সেটা তারা মোটেও মানতে রাজি নয়।
শ্রমজীবী মানুষ গুলোর শ্রমই আমাদের বিলাসবহুল জীবনের সহায়ক,বিত্তশালী মানুষ গুলো সুন্দর পোশাক, দামী গাড়ি,বাড়ী,প্রতিটি সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সব কিছুই হয় একমাত্র শ্রমজীবী নামের শ্রেষ্ঠ মানুষ গুলোর শরীরের ঘামের বিসর্জনে।তাই শ্রমজীবীদের সম্মান করতে শিখুন,শিশু শ্রমকে না বলুন,দেশ-বিদেশে অবস্থানরত সকল শ্রমজীবীদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে আজীবন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে যেন থাকে শ্রমজীবী মানুষ গুলোর ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
তাঁরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাঁরাই সোনার সন্তান, তাঁরাই সম্মান ও শ্রদ্ধার মুকুট।যারা শ্রমজীবীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে জানেনা তারা মানুষ নামের অমানুষ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে শ্রমিকদের প্রতি সম্মান ও ভক্তিশ্রদ্ধা করার কথাই বলেছিলেন।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর সংহতির দিন মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।ওই সময় তাদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ছিল না। নামেমাত্র মজুরিতে তারা মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হতেন।হে মার্কেটে আহূত ধর্মঘটী শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।ওইদিন পুলিশের গুলিতে ৬ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।এরই প্রতিবাদে ৪ মে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক।আর সেদিনও পুলিশের গুলিতে পূনরায় প্রাণ গিয়েছিল ৫ শ্রমিকের।শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে সাম্প্রতিক কয়েকজন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল।এভাবে জীবনের বিনিময়ে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের ন্যায্য অধিকার।
এরপর ১৪ জুলাই ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠাব্য দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার সঙ্গে পরে বেতনবৈষম্য দূর করণ,নূন্যতম মজুরি, নিয়োগপত্র প্রদানের মতো বিষয়ও শ্রমিকদের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়।
মে দিবসের পথ ধরেই শ্রমিকদের নানা অধিকার অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজেদের ও তাদের শ্রমের মর্যাদা পেয়েছে গুরুত্ব।বিশ্বব্যাপী ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ – সুবিধার পাশাপাশি কাজের পরিবেশও অনেক উন্নত।কিন্তু অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রমজীবী মানুষ গুলোর দূর্দশা এখনো ঘোচেনি।
আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও তা মানা হচ্ছে না।অনেক বেসরকারি শিল্প-কারখানায় আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টাও মানা হয় না।বেসরকারি অনেক শিল্প কলকারখানা গুলোতে নামেমাত্র মজুরির সাইনবোর্ড দিয়ে শ্রমিকদের একচেটিয়া খাটিয়ে মারছে।দেশে শ্রমিক শ্রেণি শুধু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত তা নয়,অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে।আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসে প্রায়ই মরতে হয় শ্রমিকদের। বহুল আলোচিত “রানা প্লাজা”ধসে পড়ে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের প্রাণ হারানো এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় “বিএম ডিপোতে” অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিক নিহতের ঘটনা অনন্তকাল পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।এছাড়াও শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যাক্ক্যারজনক ঘটনা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে শোনার কথা নতুন নয়।একজন শ্রমজীবী মানুষের উপর নির্ভর করে পুরো একটি পরিবার।আর ওই শ্রমিক যখন এধরণের কোন ঘটনা -দূর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তখন মাত্র কয়েক লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় একটি শ্রমিক পরিবারের জীবন মূল্য।এঅবস্থার অবসান ঘটিয়ে তাদের জীবন ও শ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সবাইকে।সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো, শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা।যেহেতু শ্রমজীবি মানুষ গুলো এখনো পর্যন্ত সামাজিক ভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি।নির্যাতন -নিপিড়নের গন্ডি থেকে মুক্ত করতে হবে শ্রমিকদের।
শুধু এতেই শেষ নয়,দেশের বিভিন্ন বেসরকারি অনেক কোম্পানি( সংস্থা) দেশের সহজ-সরল শ্রমজীবী মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে, ওইসব কোম্পানি(সংস্থা)গুলোর প্রতারণার খপ্পরে পড়ে সহজ-সরল শ্রমজীবী মানুষ গুলো একবেলা না খেয়ে জমানো টাকা গুলো লুটে নিচ্ছে,এতে সর্বস্ব হারাচ্ছে শ্রমিকরা।এই সংস্থা গুলো শ্রমিকদের অর্জিত সমস্ত অর্থ আত্মসাৎ করে দেউলিয়া হয়ে গেলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে লুটে নেওয়া অর্থের কোন প্রতিকার পায়না শ্রমিকরা।সাম্প্রতিক চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া এমন এক প্রতারণার কথা না বললেই হয়না।
চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় “রূপসা কোম্পানি” নামক একটি বেসরকারি কোম্পানি (সংস্থা) গার্মেন্টস শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিকদের লোভে ফেলে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেউলিয়া হয়ে গেলেও অদ্যবদি পর্যন্ত কোন অভিভাবক মেলেনি শ্রমিকদের কাছ থেকে লুটে নেওয়া সেই টাকার।এতে অন্তত কয়েক হাজার শ্রমিক সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।আমি সরকারের কাছে “রূপসা কোম্পানি”র বিচার দাবী করছি এবং ওই “রূপসা কোম্পানি”কতৃপক্ষকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে তাদের সম্পদ জব্দ করে শ্রমিকদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে নেওয়া সেই টাকা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি ও জানাচ্ছি।
আর নয় শ্রমজীবীদের শোচন, নির্বাচন, নিপীড়ন ও হত্যা।সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদেরও একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসাবে দেখা উচিত আমাদের। মহান মে দিবসে দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রইল আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকবে অবিরাম।
Leave a Reply