নিউজ ডেস্ক:
১৯২১ সালের ২০ মে, শনিবার নিজ জন্মভূমিতে ফিরতে চাওয়ার অপরাধে শতশত নিরীহ চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। অথচ সেই নির্মম ঘটনার শতবছর পূর্ণ হলেও দিবসটিকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চা শ্রমিকের দাবি ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেয়ার। ১৮৫৪ সালে ভারতের অনুর্ভর অঞ্চল অর্থাৎ উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্য প্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অভাব পীড়িত মানুষ অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাতো। গরিব মানুষের অর্থ সংকটের এই সুযোগটি সুকৌশলে কাজে লাগায় ব্রিটিশ সরকার। সিলেটের ‘মানিনিছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধূর্ত ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে প্রাথমিক ভাবে চায়ের বানিজ্যিক চাষ শুরু করে। খুব স্বাভাবিক কারণেই চা বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিক প্রয়োজন হয়। ব্রিটিশ কোম্পানী উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার মধ্য প্রদেশসহ আশপাশ এলাকা থেকে অভাব পীড়িত মানুষদের অধিক লাভের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চা বাগানে নিয়ে আসে। তাদের চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে। ২০ মে চা শ্রমিক হত্যা দিবসটি ইংরেজী বেনিয়াদী নিষ্টুর হত্যাকান্ডের স্মৃতি বহন করে। নামমাত্র মজুরিতে অমানবিক কাজে বাধ্য করে। দিন রাত খাটুনির পর যে মুজুরি পেত তা দিয়ে শ্রমিকদের ঠিকমত একবেলা খাবারও জুঠতনা। একদিকে মালিকদের অত্যাচার নির্যাতন আর মিথ্যা আশ্বাসে সৃষ্ট দারিদ্রতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রমিকরা তখন ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯২১ সালে নিজ এলাকার বা বাসস্থানে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে শ্রমিকরা। কিন্তু মাতৃভ‚মিতে যাওয়ার পথ জানা ছিলনা তাদের। তবে এটুকু ধারণা ছিল চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। ১৯২১ সালের মে মাসে চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত দেওশরা ও পন্ডিত গঙ্গা দীক্ষিতের নেতৃৃত্বে কাছাড়া ও সিলেটের ৩০ হাজার শ্রমিক রেল লাইনের পথধরে হেটে রওয়ানা দেয়। ২০ মে তারা চাঁদপুর নদীবন্দরে পৌঁছে। পথে খাদ্য সংকট ও রোগাক্রান্ত হয়ে নারী শিশু সহ অনেকে মারা যায়। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় বাগান মালিকরা শ্রমিকদের পথ-অবরোধ করতে চাঁদপুর আসাম রাইফেলসের বুর্গা সৈন্য মোতায়েন করে। তবে শ্রমিকরা দাসত্বের শৃংখল ছিন্ন করে নিজ মাতৃভ‚মিতে পৌঁছার সংকল্পে অটুট ছিল। ২০ মে শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে চাইলে বুর্গা সৈন্যরা বাধা দেয়। তখন ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা সেই বাঁধার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। শ্রমিকদের এ বিদ্রোহ দমন করতে সরকারের পক্ষে কমিশনার কিরণ চন্দ্র দেব, ম্যাজিস্টেট সুশীল সিং ইংরেজ মালিকদের প্রতিনিধি ফার্গুসবের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি করে এবং হত্যাকান্ড চালায়। যারা রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিল তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। গুলিতে মারা যান শত শত চা শ্রমিক নারী-পুরুষ। পরে তাদের মরদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয় মেঘনা নদীতে। অনেক শ্রমিক প্রাণে বাঁচতে আবারও বাগানে ফিরে আসেন। এ ঘটনার পর থেকে ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে শ্রমিকরা। তারা দাবি জানিয়েছেন ২০ মে যেন ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে সরকারী স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু আশায় আশায় শত বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে চা শ্রমিকরা তির ধনুক নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় দেশের জন্য অনেক চা শ্রমিক জীবনও দিয়েছে। কিন্তু সে শ্রমিকরা এখনও দেশে পরবাসীর মতো আছে। তাদের সেই ভূমির অধিকার তারা আজও পায়নি। তাই শ্রমিকদের একটাই দাবী ২০ মে-কে চা ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। আজ থেকে শত বছর আগে যারা চা শ্রমিক আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
লেখক: সাবেক শ্রম বিষয়ক সম্পাদক
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ।
Leave a Reply