মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ ছানুবী, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) :
আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ৩৩ বছর পূর্বে ১৯৯১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। রাতের অন্ধকারে মুহূর্তের মধ্যে সেদিন লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। নিহত হয় সোয়া লক্ষাধিক মানুষ। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই রুদ্ধশ্বাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ আর কখনো হয়নি। সেই দিনের স্বজনহারা মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয় উপকূলের আকাশ বাতাস। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপকূলবাসীসহ সারা বাংলাদেশের মানুষকে সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলে। ইতিহাসের ওই ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকার ১ লাখ ৩০ হাজার বনি আদমসহ লাখ লাখ পশুপাখি, গরু-মহিষ, হাঁস-মুরগীর করুণ মৃত্যু এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়ে প্রচুর ধনসম্পদ ভেসে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালী। শুধু বাঁশখালীতেই সেদিন ৪৫ হাজার মানুষ নিহত এবং কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সাগর পাড় থেকে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে এমন কোন ঘর এবং পরিবার ছিল না যে ঘর এবং পরিবারের একাধিক মানুষ সেদিন নিহত এবং হারিয়ে যায়নি। সেদিনের ঝড়ো ছোবল ও অথৈ পানিতে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। প্রায় ৩৭ কিলোমিটার সাগরবেষ্টিত বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা একটি মাত্র ভেড়িবাঁধের অভাবে আজও অরক্ষিত।
বাঁশখালী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ২৫১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০১৫ সালের ১৯ মে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধ নির্মাণে কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বেড়ে হয়েছিল ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২২ সালে প্রকল্পের প্রায় (৯০%) কাজ শেষ হয়। তবে কয়েক বছর যেতে না যেতেই পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে খানখানাবাদের কদমরসুল এলাকায় বাঁধ রক্ষায় নির্মিত সিসি ব্লক বেষ্টিত এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। বাঁধের একাংশ বিলীনও হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ক্ষয়রোধে লাগানো ব্লকের কোনো অস্তিত্বও নেই। প্রায় সবগুলো ব্লক ধসে যাচ্ছে। বর্তমানে বাঁশখালী উপকূলে আংশিক বেড়িবাঁধ সংস্কার হলেও এখনও পুরো উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় ২ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিলের এইদিনকে স্মরণ করে ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ঘরে-ঘরে মিলাদ মাহফিল, কোরআন খানি, দোয়া কামনা, দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন আয়োজনে দিনটি পালন করে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী চকরিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগেও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
উপকূলীয় বেড়িবাঁধকে আধুনিক বেড়িবাঁধে পরিণত করার কার্যক্রম হাতে নিলেও ঠিকাদারদের নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খুবই ধীর গতিতে চলছে উন্নয়ন কাজ। উপকূলীয় জনগণের অভিযোগ বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে যথেষ্ট অনিয়ম পরিলক্ষিত হলেও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। অথচ উপকূলবাসীর জীবন-মরণ বাঁধ খ্যাত এ বেড়িবাধটি অরক্ষিত থাকায় বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী ৫ লক্ষাধিক মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। উপকূলীয় ছনুয়া, বড়ঘোনা, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, ইলশা,পুকুরিয়া,সাধনপুর ও প্রেমাশিয়াসহ বাঁশখালীর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ প্রতি বর্ষায় আরো একটি ২৯ এপ্রিলের ছোবল আতঙ্কে রীতিমত তটস্থ থাকেন। প্রতিবছর এই দিনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উপকূলবাসীর মাঝে। বিশেষ করে খানখানাবাদ, কদমরসুল, ছনুয়া, বড়ঘোনা, গন্ডামারা ও প্রেমাশিয়া এলাকায় প্রতি বর্ষায় সামুদ্রিক লবণ পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়। এই সময় হাজার হাজার মানুষকে পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনাযাপন করতে হয়। ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপকূলীয় এলাকার অসহায় মানুষগুলোর জীবন রক্ষার্থে আধুনিক ভেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সাগর পাড় এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার এবং আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের ওয়াদা ও তাগিদ দেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও বিদেশী দানশীল ব্যক্তিবর্গ প্রায় ১১৮টি সাইক্লোন সেল্টার বাঁশখালীতে নির্মাণ করলেও তার অধিকাংশই সাধারণ জনগণের উপকারে আসছে না। অধিকাংশ সাইক্লোন সেল্টার বর্তমানে মাদকসেবী, নেশাখোর ও মাস্তানদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। ছনুয়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা ইউপি’র বেশকিছু সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণে ত্রুটি, আকারে ছোট এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলো ব্যবহার অনুপযোগী বিধায় স্থানীয় জনগণ উক্ত সাইক্লোন সেন্টার দিয়ে কোন উপকার পাচ্ছে না। তাছাড়া অধিকাংশ সাইক্লোন সেন্টার সমুদ্র উপকূলে নির্মাণ না করে প্রভাবশালীদের চাপে মহাসড়কের কোল ঘেঁষে পাহাড়ী এলাকায় অপ্রয়োজনীয় স্থানে নির্মাণ করার ফলে সেগুলোও জনগণের কোন কাজে আসছে না। প্রধান সড়কের কোল ঘেঁষে নির্মিত সাইক্লোন সেল্টারগুলো এখন স্থানীয় প্রভাবশালী, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ, মাস্তান ও অপরাধীদের নিরাপদ আখড়া। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্রীজ ও কালভার্ট নির্মাণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনায়াসেই বৃদ্ধি পায়। উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন রক্ষার্থে এখানে একটি ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ আধুনিক ভেড়িবাঁধ নির্মাণ, উপকূলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার ও আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন, বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা সাইক্লোন সেল্টার গুলো দখলমুক্ত করণ এবং উপকূলীয় এলাকার রাস্তাঘাটের সংস্কার, ব্রীজ-কালভাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে বাঁশখালী উপকূলীয় জনগণের চাহিদা পূরণে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই এগিয়ে আসতে হবে। যা উপকূলবাসীর প্রাণের দাবী।
Leave a Reply